• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

চিরিরবন্দরে সেচের কাজে এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে সেঁউতি-দোন 

প্রকাশিত: ২৮ মার্চ ২০২৪  

হারিয়ে গেছে এক সময়ের জনপ্রিয়, পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানী সাশ্রয়ী কৃষি যন্ত্র দোন ও সেঁউতি বা জাত। আগেকার দিনে কৃষকদের গ্রামে গ্রামে জমিতে দোন, সেঁউতি বা জাত দিয়ে জমিতে সেচ দিতে দেখা যেত। প্রান্তিক কৃষকরাই শুধু নয়-পানি সংকট মোকাবেলায় বিত্তবান কৃষকরাও দোন, সেঁউতি বা জাত দিয়ে ক্ষেতে সেচ দিতেন। দোন, সেঁউতি বা জাত দিয়ে জমিতে পানি সেচ দিতে খরচও কম হতো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় আধুনিকায়নের ফলে যন্ত্র সভ্যতার যাঁতাকলে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন কৃষিযন্ত্র সেঁউতি, দোন, জাত ও ডোঙা। একসময় গ্রামবাংলার কৃষিক্ষেত্রে সেচযন্ত্র হিসেবে টিন বা বাঁশের তৈরি দোন ও সেঁউতি বা জাতের ব্যাপক চাহিদা ছিল। সেচ কাজে এসব যন্ত্রের ব্যবহার ছিল অতুলনীয়। গ্রামবাংলার কৃষকের আদিকাল থেকেই চিন্তা-ভাবনার ফসল হিসেবে সেঁউতি, দোন, জাত ও ডোঙা আবিষ্কার করেছিল। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে দোন, সেঁউতি বা জাত।

আজকাল তা আর দেখা যায় না। নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুরপাড় কিংবা নিকটবর্তী এলাকার কৃষি জমিতে সেচ কাজে দোন বা সেঁউতি ব্যবহার করা হতো। মূলত কাঠ দিয়ে দোন তৈরি করা হয়। এর এক মুখ খোলা ও অন্য মুখটি বন্ধ থাকে। একটি লম্বা কাঠের মাঝখানে গর্ত করে একপাশে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নিতে হয়। শরীরের ওজন দিয়ে দোনের একপাশ পানিতে ডুবিয়ে পানি ভরে উঁচু করলেই পাথর দিয়ে বেঁধে রাখা অপরপাশ দিয়ে জমিতে পানি পড়ে।

দিনাজপুরের খানসামা ও চিরিরবন্দর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এক সময়ের খরস্রোতা ইছামতি নদী। এ নদীর বুকে কৃষকেরা সমতল জমি তৈরি করে চাষ করছেন ইরি-বোরোধান। চিরিরবন্দর উপজেলার সাতনালা ইউনিয়নের খামার সাতনালা গ্রামে এখনও দোন, সেঁউতি বা জাত দিয়ে ইছামতি নদী থেকে জমিতে পানি সেচ দিচ্ছেন কৃষক। দোন, সেঁউতি বা জাত নিয়ে কথা হয় খামার সাতনালা গ্রামের হেদল পাড়ার মৃত শহরউদ্দিনের ছেলে কৃষক মো. লুৎফর রহমানের (৩৫) সাথে। তিনি প্রতিবছর এ মৌসুমে জাতের সাহায্যে ইছামতি নদী থেকে জমিতে পানি সেচ দিয়ে চাষাবাদ করেন। তিনি ২০ বছর পূর্বে দিনাজপুরের দক্ষিণ কোতয়ালীর কমলপুর থেকে এ জাত সংগ্রহ করেছেন। এ জাতের মাধ্যমে একাকী জমিতে পানি সেচ দেয়া যায়। সেঁউতি বা টিন দিয়ে জমিতে পানি সেচ দিতে দুইজন লোকের প্রয়োজন হয়। আর এই জাত দিয়ে জমিতে পানি সেচ দিতে একজন লোক দিয়েই তা সম্ভব হয়। এটি ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে আরো অনেকদিন সেচ দেয়া যাবে। এর সুবিধা হলো-নদীর তীরে বা জমির ধারে পানি থাকায় এর সাহায্যে খুব সহজেই পানি উত্তোলন করা যায়। এতে শক্তি কম লাগে, খরচও কম এবং বেশি পরিমাণে পানি উত্তোলন করা সম্ভব। স্বল্প সময়ে জমিতে সেচ দেয়া যায়। শ্যালোমেশিনের সাহায্যে পানি সেচ দিতে তেলসহ খরচও বেশি পড়ে। এছাড়া অল্প জমিতে পানি সেচ দিতে সময়মতো শ্যালোমেশিন ভাড়া পাওয়া যায় না। আমরা গরীব মানুষ আমাদের পক্ষ্যে শ্যালোমেশিন কেনাও সম্ভব নয়।

এ জাতের সাহায্যে সহজেই ঢ্যাক বাঁশ দিয়ে খুঁটিতে পানির ওপরে দাঁড়িয়ে জমিতে পানি সেচ দেয়া যায়। কোনো রকম ঝক্কি-ঝাঁমেলা ছাড়াই এটি সহজেই পরিবহন করা যায়। এতে কোনো পরিবহন খরচ লাগে না। ক্ষেতে সপ্তাহে একবার সেচ দিয়ে আবার কয়েকদিন পর সেচ দিতে হয়।

ওই গ্রামের হেদলাপাড়ার মৃত মনিরউদ্দিনের ছেলে কৃষক মোবারক আলী (৬৭) বলেন, হামরা গরীব মানুষ। এখন পানি সেচের জন্য কত আধুনিক যন্ত্রপাতি বেরাইছে (বের হয়েছে)। শ্যালোমেশিন, ডিপমর্টার আরো কত কী? হামার এ্যাতো টাকা নাই, যা দিয়া হামরা ওইলা যন্ত্র কিনিবার পারি। এমনিতেই পানির দাম দিবার পারি না। মোর (আমার) কপাল ভালো যে, মোর ভুইর (জমি) পাশোত (পাশে) তাও (তারপর) পানি আছে। না হইলে যে মোর কী হইল হয়? মৃত মহিরউদ্দিনের ছেলে কৃষক আলতাব হোসেন (৪০) ও মৃত শহরউদ্দিনের ছেলে মো. হবিবর রহমান (৪৬) বলেন, হামরা (আমরা) বাপ-দাদার ঘরক দোন ও সেঁউতি দিয়া জমি বাড়িত পানি দিবার দ্যাখিচি (দেখছি)। হামরা (আমরা) গরীব মানুষ। অত টাকা-পাইসাও নাই। ম্যাশিন কিনিমো (ক্রয় করা) কি দিয়া। তাই জাত দিয়া নদী থাকি পানি তুলি জমিত দিয়া ফসল ফলাই। এখন আধুনিক মেল্লা (অনেক) যন্ত্রপাতি বাজারত পাওয়া যাওয়ার কারণে এ্যাইলার (এগুলো) ব্যবহার তেমন হয় না।

উপজেলার রানীরবন্দরের ঐতিহ্যবাহী ইছামতি ডিগ্রি কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান জানান, আমি ছোটবেলায় দেখেছিলাম কৃষকেরা সেঁউতি, দোন বা ডোঙা দিয়ে খাল হতে পানি উত্তোলন করে তারা তাদের জমিতে দিতো। এখন আর আগের মতো এসব চোখে পড়ে না। তবে এখনও গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের সেঁউতি, দোন, জাত ও ডোঙা দিয়ে পানি উত্তোলন করতে দেখতে পাওয়া যায় না। আধুনিক যন্ত্র সভ্যতা আমাদের জন্য আর্শীবাদ হলেও গ্রামীণ ঐতিহ্যের ধারক-বাহক আমাদের পূর্বপুরুষদের তৈরি কৃষি যন্ত্রপাতি সভ্য সমাজ ও অনাগত জাতীর চেনার জন্য চালু রাখা প্রয়োজন।

উপজেলার রানীরবন্দর সচেতন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মো. সফিকুল আলম (সফি) বলেন, নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুরে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় সেঁউতি, দোন, জাত ও ডোঙার ব্যবহার আর আগের মতো চোখে পড়ে না। তবে যে সব জায়গায় সেচ পাম্প অপ্রতুল সেসব জায়গায় এখনও সেঁউতি, দোন, জাত ও ডোঙার ব্যবহার দেখা যায়। সেঁউতি, দোন, জাত ও ডোঙা দিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানি সেচ দেয়ায় সুবিধা পাওয়া যায়। রবি মৌসুমে কৃষকেরা নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুর থেকে সেঁউতি, দোন, জাত ও ডোঙা দিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে থাকে। পানির উৎসের নিকটবর্তী জমিতে দোন বা সেঁউতি দিয়ে সেচ দেয়া অনেক সাশ্রয়ী। সহজ এসব পদ্ধতিগুলো বহুকাল গ্রামবাংলায় ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। 

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –